মিরপুর ১৪ নম্বর এলাকার একটি পোশাক কারখানার এক কর্মকর্তার সঙ্গে এক শ্রমিকের বিরোধ ঘিরে ওই কারখানায় কয়েক দিন ধরে কাজ বন্ধ ছিল। এই পরিস্থিতিতে ‘কাজ না করলে বেতন নয়’ (নো ওয়ার্ক নো পে) নোটিশ টাঙিয়েছিল কারখানা কর্তৃপক্ষ। আজ সকালে সেই নোটিশ দেখেই বিক্ষোভ করেন শ্রমিকেরা। একপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন।
পরে রাস্তায় নামেন আশপাশের কারখানাগুলোর শ্রমিকেরা। বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে পুরো এলাকায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যাওয়া যৌথ বাহিনীর সঙ্গে দুই ঘণ্টার বেশি সময় ধরে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। দুই শ্রমিক গুলিবিদ্ধ হন। শ্রমিকেরা পুলিশ ও সেনাবাহিনীর দুটি গাড়ি পুড়িয়ে দেন।
আজ দুপুরে সরেজমিনে মিরপুর ১৪ নম্বরসংলগ্ন পুরান কচুক্ষেত এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, রাস্তার পাশে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর পুড়ে যাওয়া পিকআপ ভ্যান দুটি পড়ে আছে। রাস্তায় গাড়ির কাচের টুকরা ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রয়েছে। সেখানে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর সদস্যরা সাঁজোয়া যানে সশস্ত্র অবস্থান নিয়েছেন।
আহত দুই পোশাকশ্রমিক আল আমিন (১৮) ও ঝুমা আক্তারকে (১৫) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে আল আমিনের কাঁধে ও পিঠের ওপরের দিকে এবং ঝুমার ডান পায়ের গোড়ালিতে গুলি লেগেছে। ঢাকা মেডিকেল পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক মো. ফারুক জানান, আহত ঝুমাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। আর আল আমিনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে কাফরুল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী গোলাম মোস্তফা বলেন, বিক্ষুব্ধ পোশাকশ্রমিকেরা পুলিশ ও সেনাবাহিনীর দুটি পিকআপ ভ্যান পুড়িয়ে দিয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে যৌথ বাহিনী লাঠিপেটা, কাঁদানে গ্যাসের শেল ও গুলি ছুড়তে বাধ্য হয়েছে। এ ঘটনায় কাউকে আটক করা হয়নি। সন্ধ্যা পর্যন্ত এ বিষয়ে মামলাও হয়নি।
মিরপুর ১৪ নম্বরসংলগ্ন পুরান কচুক্ষেত প্রধান সড়কের পাশের মৌসুমী অ্যান্ড ভূঁইয়া প্লাজায় অবস্থিত ক্রিয়েটিভ ডিজাইনারস লিমিটেড (সিডিএল) নামের কারখানা থেকে এই বিক্ষোভ–সংঘর্ষ হয়েছে বলে জানান পুলিশ কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফা। তিনি বলেন, চার-পাঁচ দিন আগে সিডিএল পোশাক কারখানার শ্রমিক মো. শরীফ কারখানায় এসে কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেন, কারখানাটির লাইন চিফ কবির হোসেনের শ্যালক তাঁকে মারধর করেছেন। এ জন্য কবিরকে কারখানা থেকে বহিষ্কার করার দাবি করেন তিনি এবং ভবিষ্যতে তাঁর ওপর কোনো ধরনের হামলা চালাবে না, সেই অঙ্গীকার কবিরকে লিখিত দিতে হবে। শরীফের অভিযোগের ভিত্তিতে সিডিএলের লাইন চিফকে বহিষ্কার করে কারখানা কর্তৃপক্ষ। কিন্তু শরীফ দাবি করেন, কবিরকে পোশাক কারখানার শ্রমিকদের সামনে এসে মাফ চাইতে হবে। এই দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা কাজ করবেন না বলে ঘোষণা দেন। কয়েক দিন ধরে পোশাকশ্রমিকেরা কারখানায় এলেও কাজ করছিলেন না। গত বুধবার রাতে সিডিএলের পণ্য রপ্তানির জন্য গাড়িতে তোলা হচ্ছিল। খবর পেয়ে ওই কারখানার ৪০-৫০ জন পোশাকশ্রমিক এসে ওই মালামাল আটক করেন। খবর পেয়ে সেনবাহিনী ও পুলিশ এসে ধাওয়া দিলে তাঁরা পালিয়ে যান। আজ সকালে সিডিএল কর্তৃপক্ষ কারখানার সামনে ‘নো ওয়ার্ক, নো পে’ সংবলিত নোটিশ ঝুলিয়ে দেয়।
ক্রিয়েটিভ ডিজাইনারসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ তারেক সরকার বলেন, শ্রমিক আন্দোলনের পেছনে বেতন-ভাতার কোনো সম্পর্ক নেই। মূলত সাবেক এক কর্মীকে শ্রমিকেরা তাঁদের হাতে তুলে দেওয়ার দাবিতে তিন দিন ধরে কর্মবিরতি ও বিক্ষোভ করেন। বিভিন্নভাবে তাঁদের বোঝানোর চেষ্টা করে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। শেষ পর্যন্ত বুধবার রাতে কারখানা বন্ধ করতে হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল সাড়ে আটটার দিকে শ্রমিকেরা কারখানায় এসে ওই নোটিশ দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। এ সময় তাঁরা কারখানার ওই নোটিশ প্রত্যাহারের দাবিতে দাবিতে বিক্ষোভ করেন। একপর্যায়ে শ্রমিকেরা সড়ক অবরোধ করেন। যৌথ বাহিনীর সদস্যরা তাঁদের ধাওয়া দিলে তাঁরা এলাকা ছেড়ে চলে যান। এর কিছুক্ষণ পর পাশের ডায়েনা নামের একটি পোশাক কারখানার শ্রমিকেরা ওই কারণার (সিডিএল) সামনে এসে স্লোগান দেন, ‘আমার ভাই মরল কেন জবাব চাই, দিতে হবে’। এরই মধ্যে একের পর এক মিরপুর ১৪ নম্বরের পোশাক কারখানা থেকে শত শত শ্রমিক এসে সিডিএলের সামনে আন্দোলনরত শ্রমিকদের সঙ্গে যোগ দেন। তখন মিরপুর ১৪ নম্বরের সঙ্গে সংযোগ সড়কগুলোতে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে দুর্ভোগ পড়েন অফিসগামী মানুষ। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে মিরপুর ১৪ নম্বরের ৭টি পোশাক কারখানা কর্তৃপক্ষ ছুটি ঘোষণা করে। ওই সব কারখানার শ্রমিকেরাও রাস্তায় নেমে বিক্ষোভে অংশ নেন।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বেসরকারি ডাচ্–বাংলা ব্যাংকের এটিএম বুথের নিরাপত্তাকর্মী জিয়াউল হক বলেন, সেনাবাহিনী ও পুলিশ সদস্যরা সকালে আন্দোলনরত পোশাকশ্রমিকদের রাস্তা থেকে সরে যেতে অনুরোধ করেন। কিন্তু বিক্ষুব্ধ শ্রমিকেরা ও আশপাশের পোশাক কারখানার ছাদ থেকে অনেকে যৌথ বাহিনীর ওপর ইট পাটকেল ছুড়ে মারেন। এ নিয়ে পোশাকশ্রমিকদের সঙ্গে যৌথ বাহিনীর পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষ হয়। একপর্যায়ে পুলিশের পিকআপ ভ্যান ও সেনাবাহিনী তাদের ব্যবহৃত পিকআপ ভ্যান রাস্তায় রেখে পিছু হটে। এ সময় বিক্ষুব্ধ শ্রমিকেরা পুলিশ ও সেনাবাহিনীর দুটি গাড়িতে ভাঙচুর চালান ও পরে তাতে আগুন লাগিয়ে দেন। তখন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নেভান। পরে যৌথ বাহিনী রাস্তা থেকে অবরোধকারীদের সরে যেতে অনুরোধ করে। তখন পোশাকশ্রমিকেরা আবার তাদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হন। সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ সংঘর্ষ পুরান কচুক্ষেত এলাকা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় যৌথ বাহিনী লাঠিপেটা করে ও গুলি চালায়। তখন আতঙ্কে আশপাশের দোকানপাট ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ সময় আল আমিন ও ঝুমা আক্তার নামের ওই দুই পোশাকশ্রমিক গুলিবিদ্ধ হন। বেলা ১১টার দিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ধীরে ধীরে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আল আমিনের বাবা আবদুর রহমান এবং আল আমিনের সহকর্মী লিপা আক্তার জানান, তাঁরা পুরান কচুক্ষেত এলাকার স্যান টেক্স ফ্যাশন নামের একটি পোশাক কারখানার শ্রমিক। বিক্ষোভ শুরু হলে কর্তৃপক্ষ তাদের ছুটি দেয়। তখন তাঁরা রাস্তায় বেরিয়ে আসেন। তাঁরা শুনেছেন, বকেয়া বেতনের দাবিতে সিডিএল কারখানার শ্রমিকেরা রাস্তায় নেমেছিলেন। তখন তাঁদের বাধা দেওয়া হয়। এই খবরে শ্রমিকেরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন।