ভারতীয় শতকোটিপতি গৌতম আদানি চেয়েছিলেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জ্বালানি ও অবকাঠামো সাম্রাজ্য গড়ে তুলবেন। কিন্তু কাজ পেতে তিনি ও তাঁর সহযোগীরা ঘুষ দিয়েছিলেন বলে যুক্তরাষ্ট্র যে অভিযোগ এনেছে, তাতে তাঁর সেই স্বপ্ন হোঁচট খেয়েছে। বিশ্লেষকেরা অবশ্য মনে করেন, গৌতম আদানি আরও একবার ঘুরে দাঁড়াবেন।
বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, গত বুধবার নিউইয়র্কে গৌতম আদানি ও তাঁর সহযোগীদের অভিযুক্ত করা হয় ঘুষ দেওয়ার অভিযোগে। এতে বলা হয়, লোভনীয় সরকারি কাজ পেতে তাঁরা ২৫ কোটি ডলারের বেশি ঘুষ দিয়েছেন। এরপর তাঁর কোম্পানির শেয়ার বিক্রির ধুম পড়ে যায়।
কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ভারতের বিরোধীদলীয় নেতা রাহুল গান্ধী গৌতম আদানিকে গ্রেপ্তার করার দাবি জানান। অন্যদিকে কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম রুটো আদানি গোষ্ঠীর সঙ্গে করা বিমানবন্দর ও বিদ্যুৎ–সংক্রান্ত চুক্তি বাতিল করেন। এসব চুক্তির আর্থিক মূল্য ছিল ২৫০ কোটি ডলার।
আদানি গ্রুপ তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ‘ভিত্তিহীন’ বলে নাকচ করে দিয়েছে। তবে করপোরেট সুশাসনবিষয়ক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ইনগভ রিসার্চ সার্ভিসেসের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীরাম সুব্রামানিয়াম মনে করেন, মার্কিন ওই অভিযোগের ‘বড় ধরনের’ তাৎপর্য রয়েছে। তিনি বলেন, তারা আপিল করবে কিংবা নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করবে। তবে এটি তাদের সুনাম ও করপোরেট সুশাসনের ওপর বড় একটি আঘাত।
হিনডেনবার্গ ও বিচার বিভাগের তুলনা
গৌতম আদানির উত্থান হয়েছে অনেকটা রকেটের গতিতে। একসময় তিনি বিশ্বের দ্বিতীয় ধনী ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু বিতর্ক তাঁর পিছু ছাড়ছে না। অভিযোগ রয়েছে যে হিন্দু জাতীয়তাবাদী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে তিনি সুবিধা পেয়েছেন। এর আগে মার্কিন শর্টসেলার কোম্পানি হিনডেনবার্গ রিসার্চ আদানির বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ এনেছিল।
২০২৩ সালে হিনডেনবার্গের আনা ওই অভিযোগের পর আদানি গোষ্ঠীর বাজার মূলধন ১৫ হাজার কোটি ডলার কমে যায়। উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, ‘আদানির যে যোগাযোগ রয়েছে, তার বলে তিনি পুরোনো অবস্থানে ফিরে আসতে সক্ষম। গতবারে আমরা সেটা দেখেছি।’
গৌতম আদানি নানা খাতে তাঁর সামাজ্যের বিস্তার করেছেন। কয়লা থেকে শুরু করে বিমানবন্দর, সিমেন্ট ও গণমাধ্যমে তাঁর বিনিয়োগ রয়েছে। তাঁর স্বার্থ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া, বাংলাদেশ, ভুটান, ইসরায়েল, শ্রীলঙ্কা, তানজানিয়া ও নেপালে।
তবে মাইকেল কুগেলম্যান মনে করেন, এবার আদানির চ্যালেঞ্জ ‘নজীরবিহীন’। তিনি বলেন, ‘আপনি যদি মার্কিন বিচার বিভাগের মাধ্যমে অভিযুক্ত হন, তাহলে তার গুরুত্ব ও গভীরতা একেবারেই অন্য রকম। এখন তিনি যার মুখোমুখি হয়েছেন, তার তুলনায় হিনডেনবার্গের অভিযোগ তেমন কিছুই ছিল না।’
ঘুষের এ অভিযোগ মূল বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি বিশাল বাধা। এরই মধ্যে দাবি উঠেছে যে বড় প্রকল্পগুলো নিরীক্ষা করে দেখা হোক। প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কায় আদানি গ্রিন এনার্জির ৪৪ কোটি ২০ লাখ ডলারের একটি বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরোধিতাকারীরা চুক্তিটি স্থগিত রাখার দাবি জানিয়েছেন।
ধীরে চলো
ভারতের সবচেয়ে বড় সমুদ্রবন্দর পরিচালনাকারী কোম্পানি হলো আদানি। পাশাপাশি বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিমানবন্দরও পরিচালনা করে এই কোম্পানি। যার মধ্যে রয়েছে আর্থিক কেন্দ্র মুম্বাই ও নরেন্দ্র মোদির নিজের রাজ্য গুজরাটের সবচেয়ে বড় শহর আহমেদাবাদের বিমানবন্দর।
এর বাইরে রয়েছে ভারতজুড়ে বিভিন্ন কয়লা ও নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎকেন্দ্র।
যুক্তরাষ্ট্রে যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন গৌতম আদানির ভাইয়ের ছেলে ও কোম্পানির পরিচালক সাগর আদানি। গত অক্টোবরে তিনি এএফপিকে বলেছিলেন যে আদানি গ্রুপের সঙ্গে মোদি সরকারের কোনো ‘রাজনৈতিক যোগাযোগ নেই’।
মুম্বাইভিত্তিক বিশ্লেষক হিমেন্দ্র হাজারি বলেন, আদানি গোষ্ঠী অবকাঠামো নির্মাণের জগতে অনেকটাই নতুন এসেছে এবং তাদের পেছনে আছেন বড় বড় বিনিয়োগকারী। তিনি আরও বলেন, আদানি গ্রুপের সীমিত ব্যবস্থাপনা সক্ষমতা ও অভিজ্ঞতা থাকার পরও এই বিনিয়োগকারীরা টাকা ঢেলেছেন। কারণ, তাঁরা মনে করেছেন, ভালো লাভ হবে।
হিমেন্দ্র হাজারি বলেন, যেকোনো স্বাভাবিক বাজার অর্থনীতিতে এই বিনিয়োগকারীরা হয়তো এমনভাবে বিনিয়োগ করতেন না। তিনি জানান, আদানির ঋণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এসেছে ব্যাংক, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানসহ বিদেশি উৎস থেকে। এখন থেকে পুরো প্রক্রিয়া ধীরগতির হয়ে পড়বে।
সুনামহানি
গৌতম আদানি অভিযুক্ত হলেও ভারতের সরকার এখনো কোনো মন্তব্য করেনি।
তবে বিরোধী নেতা রাহুল গান্ধী দেরি না করেই গৌতম আদানির গ্রেপ্তার দাবি করেছেন। তবে তিনি সাংবাদিকদের এ কথাও বলেছেন যে তিনি জানেন, আদানির ব্যাপারে সরকার কিছুই করবে না। কারণ, ‘মোদি তাঁকে রক্ষা করছেন’।
আর নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) পাল্টা অভিযোগ করে বলেছে, ঘুষের যে অভিযোগ উঠেছে, তার সঙ্গে জড়িত আছে সেসব রাজ্য, যেখানে বিরোধী দলগুলো ক্ষমতায় রয়েছে।
ইনগভ রিসার্চ সার্ভিসেসের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীরাম সুব্রামানিয়াম বিশ্বাস করেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আদানি অভিযুক্ত হওয়ার ঘটনা আদানির সুনামের প্রতি একটি ‘ধাক্কা’। তবে তারা ভারত ও বাকি বিশ্বে প্রকল্প খুঁজে বেড়াবে এবং পাবেও।
তবে মাইকেল কুগেলম্যান সতর্ক করে বলেন, সুনামহানি কেবল আদানি গ্রুপের ক্ষেত্রে ঘটেনি; বরং তা ভারতকেও আঘাত করেছে। এটা ‘মারাত্মক রকমের’ সুনামহানি। ভবিষ্যতের বিষয়ে তিনি বলেন, এই পরিবর্তন পরবর্তী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে কীভাবে প্রভাবিত করবে, তা এখনো ‘অজানা’। তাঁর কথায়, ‘আমি মনে করি না এটা ভারত–যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ককে মোটাদাগে ক্ষতি করবে।’
মাইকেল কুগেলম্যান অবশ্য এ–ও মনে করেন যে ট্রাম্প হয়তো আদানির মতো একজন কৌশলী ব্যবসায়ীকে ‘অনুকূলভাবে’ দেখতে পারেন কিংবা তিনি এ ঘটনাকে ‘আরও অনুকূল শুল্কনীতির স্বার্থে ব্যবহার করতে পারেন’।