ধর্ম

দৃষ্টির হেফাজতের বিস্ময়কর প্রভাব

দৃষ্টির হেফাজতের বিস্ময়কর প্রভাবদৃষ্টির হেফাজতের বিস্ময়কর প্রভাব

চোখ মানুষের অন্তরের আয়নাস্বরূপ। যখন তা অবনত রাখা হয়, তখন প্রবৃত্তি দমিয়ে রাখা সহজ হয়। আর যখন স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেওয়া হয়, তখন নিষিদ্ধ জায়গায় দৃষ্টি পড়ে যায়। এক পর্যায়ে সে অপরাধে লিপ্ত হয়ে পড়ে।

এ জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ আদম সন্তানের ওপর জিনা-ব্যভিচারের একটি অংশ লিখে দিয়েছেন তা সে অবশ্যই পাবে। সুতরাং চোখের জিনা হলো (হারাম বস্তুর দিকে) তাকানো এবং জিহ্বার জিনা হলো কথা বলা। মন কামনা ও আকাঙ্ক্ষা করে, লজ্জাস্থান তাকে সত্য অথবা মিথ্যা প্রমাণ করে।’ (বুখারি, হাদিস : ৬২৪৩)

আল্লামা খাত্তাবি (রহ.) এই হাদিসের ব্যাখ্যায় লিখেছেন, দেখা ও কথা বলাকে জিনা বলার কারণ—এ দুটিই হচ্ছে প্রকৃত জিনার ভূমিকা বা জিনার মূল কাজের পূর্ববর্তী স্তর।

কেননা দৃষ্টি হচ্ছে মনের গোপন জগতের উদ্রেককারী আর জিহ্বা হচ্ছে বার্তা বাহক। যৌনাঙ্গ হচ্ছে বাস্তবায়নের হাতিয়ার—সত্যে রূপান্তরকারী। (মাআলিমুস সুনান : ৩/২২৩)

হাফেজ ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) বলেন, ‘দৃষ্টিই হচ্ছে যৌন লালসা উদ্রেককারী, বার্তাবাহক। কাজেই এই দৃষ্টির নিয়ন্ত্রণ ও সংরক্ষণ মূলত যৌনাঙ্গেরই হেফাজত।

যে ব্যক্তি দৃষ্টিকে অবাধ, উন্মুক্ত ও সর্বগামী করে, সে নিজেকে নৈতিক পতন ও ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়। মানুষ নৈতিকতার ক্ষেত্রে যত বিপদ ও পদস্খলনেই নিপতিত হয়, দৃষ্টিই হচ্ছে তার সব কিছুর মূল কারণ। কেননা দৃষ্টি প্রথমত আকর্ষণ জাগায়। আর আকর্ষণ মানুষকে চিন্তা-ভাবনায় নিমজ্জিত করে। এই চিন্তা সৃষ্টি করে লালসা।

এটি আকাঙ্ক্ষা তৈরি করে। আর তা শক্তিশালী হয়ে দৃঢ়সংকল্পে পরিণত হয়। এই দৃঢ়সংকল্প অধিকতর শক্তি অর্জন করে বাস্তবে ঘটনা সংঘটিত করে। বাস্তবে যখন কোনো বাধা থাকে না, তখন এই বাস্তব অবস্থার সম্মুখীন না হয়ে কারো কোনো উপায় থাকে না।’ (আল জাওয়াবুল কাফি পৃষ্ঠা-২০৪)

ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, ‘দৃষ্টি হচ্ছে এমন একটি তীর, যা মানুষের হৃদয়ে বিষের উদ্রেক করে।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির : ৩/৩৭৬)

অন্যদিকে দৃষ্টির হেফাজতের সুফল দুনিয়ায়ও মেলে। একটি যুদ্ধের ঘটনা। উবায়দা ইবনে জাররাহ (রা.) একবার সাহাবাদের নিয়ে অমুসলিদের দুর্গে হামলা করলেন। দুর্গ অবারোধ করে রাখলেন। অবরোধ দীর্ঘ হয়ে গেল। বিজয় হচ্ছিল না। যখন অমুসলিমরা দেখল, মুসলমানরা অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে দুর্গ অবরোধ করে রেখেছে। তখন তারা একটি ষড়যন্ত্র করল যে আমরা মুসলমানদের বলব, আমরা দুর্গের দরজা তোমাদের জন্য খুলে দিচ্ছি। তোমরা শহরে প্রবেশ করো। ষড়যন্ত্র হলো, শহরের দরজা যেদিক দিয়ে খুলছিল, সেদিকে লম্বা বাজার ছিল। যার দুই পাশে দোকান ছিল। সেই বাজার শাহি মহলে গিয়ে শেষ হয়েছিল। তারা বাজারের দুই পাশে সুন্দরী নারীদের সাজিয়ে প্রত্যেক দোকানে একজন করে বসিয়ে দিল।

তাদের বলে দিল, যদি মুজাহিদরা তোমাদের সঙ্গ চায়, তাহলে তোমরা অস্বীকৃতি জানাবে না। এদিকে আমরা পেছন দিক থেকে আক্রমণ করব।

যখন এ প্রস্তাব দেওয়া হলো, তখন আবু উবায়বা ইবনে জাররাহ (রা.) ভাবলেন, এতক্ষণ পর্যন্ত এই লোকগুলো মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত ছিল; দরজা খুলছিল না। এখন হঠাৎ কী হলো যে তারা দরজা খোলার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল! এতে নিশ্চয়ই কোনো ষড়যন্ত্র আছে। সুতরাং তিনি সৈন্যবাহিনীকে একত্র করে বয়ান দিলেন। বললেন, মহান আল্লাহর কৃতজ্ঞতা। তারা হাতিয়ার নামিয়ে ফেলেছে। আমাদের প্রবেশের জন্য আহ্বান জানাচ্ছে। আপনারা অবশ্যই প্রবেশ করবেন। কিন্তু আমি আপনাদের সামনে কোরআনে কারিমের একটি আয়াত তিলাওয়াত করছি। আপনারা এ আয়াত পড়তে পড়তে এবং এর ওপর আমল করতে করতে প্রবেশ করবেন। সে সময় তিনি এ আয়াত তিলাওয়াত করলেন, অর্থাৎ ‘মুমিনদের বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা আছে।’ (সুরা : নুর, আয়াত : ৩০)

সুতরাং তাঁরা দুর্গে এভাবে প্রবেশ করলেন যে তাঁদের দৃষ্টি ছিল নিচু। তাঁরা পুরো বাজার অতিক্রম করলেন। শাহি মহল পর্যন্ত পৌঁছে গেলেন। কেউ ডানে-বাঁয়ে চোখ উঠিয়ে দেখলেন না যে কী ফিতনা ওই দোকানগুলোতে তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছে। শুধু তাঁদের এ দৃশ্য দেখে অগণিত শহরবাসী মুসলমান হয়ে গেল। (ইসলাহি খুতুবাত : ১৫/৯৮)

মহান আল্লাহ পূর্ববর্তী মনীষীদের মতো আমাদেরও দৃষ্টি হেফাজতের তৌফিক দান করুন।

Leave a Reply