পার্বত্য অঞ্চলে শান্তির খোঁজে প্রায় ২৭ বছর আগে শান্তি চুক্তি হয়েছিল। কিন্তু শান্তি ফেরেনি। এখনও পড়ছে লাশ, ঝরছে রক্ত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শান্তি চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন এবং দৃষ্টান্তমূলক বিচারই পারে পাহাড়ে শান্তি ফেরাতে। এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।
সর্বশেষ খাগড়াছড়িতে মোটরসাইকেল চোর সন্দেহে পিটুনিতে এক বাঙালি যুবকের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে আবারও অশান্ত হয়ে উঠেছে পার্বত্য অঞ্চল। একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে হঠাৎ কেন তিন পার্বত্য জেলা এমন অশান্ত হয়ে উঠলো সেটি নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন।
সংঘাত এড়াতে পার্বত্য জেলাগুলোর পাড়া-মহল্লায় পাহাড়ি ও বাঙালিদের নিয়ে বৈঠক করছে জেলা প্রশাসন। গঠন করা হয়েছে একাধিক সম্প্রীতি কমিটিও।
পার্বত্য অঞ্চল হঠাৎ করে অশান্ত হওয়ার পেছনে রাজনৈতিক কারণ থাকতে পারে বলে মনে করছেন পাহাড়িরা। দীঘিনালার একটি স্কুলের শিক্ষক পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর পাহাড়ে এক ধরনের থমথমে অবস্থা বিরাজ করছিল। আমরা আশঙ্কা করছিলাম, কিছু একটা ঘটতে পারে? পরে সেটাই সত্যি হলো। এলাকার বাঙালি যুবকরা অভ্যুত্থানের পর আমাদের বিগত সরকারের দোসর বানিয়ে শিক্ষা দেওয়ার কথা বাজারে বলাবলিও করেছে। বিষয়গুলো প্রশাসনের নজরেও ছিল। কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। পূর্ব পরিকল্পনা না হলে খাগড়াছড়ি সদরের ঘটনা নিয়ে দীঘিনালায় কেন আগুন দেওয়া হবে? আমাদের উপজেলা তো জেলা সদর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে। আরও তো অনেক উপজেলা আছে, সেখানেও তো হতে পারত? ফলে মনে হচ্ছে, যা হয়েছে তা ছিল পরিকল্পিত।”
শান্তি চুক্তি পুরো বাস্তবায়ন হয়নি
শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে। এর মূল কথা কথা ছিল, পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ থাকবে এবং সেজন্য বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান ও আইন প্রণয়নের কথা বলা হয়েছিল। এর মধ্যে ছিল তিন পার্বত্য জেলার স্থানীয় সরকার পরিষদ সমন্বয়ে একটি আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করা হবে। উপজাতীয় আইন এবং সামাজিক বিচারকাজ এই পরিষদের অধীনে থাকবে; পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করা; উপজাতীয়দের ভূমি মালিকানা অধিকার ফিরিয়ে দেয়া; পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করা ইত্যাদি।
শান্তি চুক্তির ধারাবাহিকতায় বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান সে অঞ্চলে গঠন করা হয়েছে। কিন্তু চুক্তির গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার জনসংহতি সমিতি বলছে, প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয়েছে বটে কিন্তু সেগুলোর হাতে ক্ষমতা নেই। যেমন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান হচ্ছেন জনসংহতি সমিতির নেতা জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা। এই প্রতিষ্ঠানটি কার্যত নিষ্ক্রিয় রয়েছে। এছাড়া জেলা পরিষদগুলোর উপর আঞ্চলিক পরিষদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই বলে দাবি তাদের।
দীর্ঘদিন ধরে পার্বত্য এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করছেন অধিকার কর্মী খুশি কবীর। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছাড়া সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। কিন্তু আমরা বরাবরই রাজনৈতিক নেতাদের অনাগ্রহ দেখেছি। আসলে শান্তি চুক্তির বাস্তবায়ন হওয়া জরুরি। তাহলেও কিছুটা শান্তি সেখানে মিলতে পারে।”
শান্তি চুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হওয়ায় গত ২৬ বছরে ছয়টি আঞ্চলিক দলের সৃষ্টি হয়েছে পাহাড়ে। এসব দল নিজেরাও অভ্যন্তরীণ বিরোধেও জড়াচ্ছে।
অবশ্য চুক্তির ব্যাপারে সরকার দাবি করছে পার্বত্য চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে এ পর্যন্ত ৬৫টি ধারা সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। কিন্তু জনসংহতি সমিতির দাবি ৭২টি ধারার মধ্যে মাত্র ২৫টি ধারা বাস্তবায়ন হয়েছে। ১৮টি ধারার আংশিক বাস্তবায়ন হয়েছে। এ কারণে সুফল মিলছে না।
পাহাড়ের অন্যতম সমস্যা ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ২০০১ সালে গঠন করা হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন। এ পর্যন্ত ছয়বার কমিশনের চেয়ারম্যান পরিবর্তন হলেও ভূমি বিরোধ সমস্যা সমাধানে কোনো সফলতা আসেনি।
তিন পার্বত্য জেলা থেকে ভূমি বিরোধ নিয়ে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিদের কাছ থেকে প্রায় ২২ হাজার দরখাস্ত জমা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এসব আবেদনের সুরাহা করা হয়নি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব শামিমুল হক ছিদ্দিকী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের দায়িত্ব শুধু পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নয়। এখানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় যুক্ত। আমরা বিষয়টির সমন্বয় করে থাকি। ফলে কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে সেটা এভাবে বলা মুশকিল। সর্বশেষ যে ঘটনাটি ঘটেছে সেখানে ক্ষতিগ্রস্তদের কিছু ক্ষতিপূরণ আমাদের মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া হচ্ছে। উপদেষ্টা মহোদয় ইতিমধ্যে এ ব্যাপারে বলেছেন।”
একের পর হত্যাকাণ্ড, বিচার হয়নি একটিরও
সামরিক-বেসামরিক বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, পাহাড়ে সশস্ত্র তৎপরতায় লিপ্ত থাকা সন্ত্রাসীদের হাতে স্বাধীনতার পর থেকে চুক্তির পূর্ববর্তী সময়ে নিহত, আহত ও অপহরণ কিংবা নিখোঁজের শিকার হয়েছেন অন্তত ৮ হাজার ১৪০ জন। নিহতদের মধ্যে ১ হাজার ১৩৮ জন পাহাড়ি। বাঙালি আছেন ১ হাজার ৪৪৬ জন। এই সময়ে বিভিন্ন বাহিনীর ৩৮০ জন সদস্য নিহত হয়েছেন।
আর শান্তি চুক্তি হওয়ার পরও ৮৯৯ জন পাহাড়ি, ৩৯০ বাঙালি এবং সামরিক-আধাসামরিক বাহিনীর ২৬ জনসহ ১ হাজার ৩১৫ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন প্রায় ১ হাজার ৮২৩ জন। চুক্তি পরবর্তী সময়ে পাহাড়ে অপহরণের শিকার হয়েছেন ২ হাজার ১৯৮ জন। কিন্তু কোনো ঘটনারই দৃষ্টান্তমূলক বিচার হয়নি।
অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে প্রত্যাশা
মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পাহাড়ে যেটা হচ্ছে, সেটা শোভন নয়। আমরা সেখানে আর কোনো রক্তপাত দেখতে চাই না। আমরা এটাও চাই না যে, নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে কেউ মৃত্যুবরণ করুক। অন্তর্বর্তী এই সরকারে পাহাড়ের বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখবে সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।”
আদিবাসী নেতা ও মানবাধিকার কর্মী ইলোরা দেওয়ান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সমতলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পাহাড়ের ছেলেরাও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আন্দোলন করেছে। আমরা তো চেয়েছিলাম সারাদেশে বৈষম্যমুক্ত একটা সরকার বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হবে। কিন্তু পাহাড় এখনও বৈষম্যমুক্ত হয়নি। সারাদেশের মতো পাহাড়েও দেওয়াল লিখন বা গ্রাফিতি করেছিল ছেলেরা। কিন্তু সেগুলো মুছে ফেলা হয়েছে। কিন্তু দেশের অন্য কোথাও তো এটা হয়নি। পরিবর্তনের পরও কেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে আমাদের ছেলেরা মারা যাবে? আসলে বৈষম্যমুক্ত করার জন্য এখনও আন্তরিকতার ঘাটতি আছে। আমরা আশা করি, এখন যিনি সরকারপ্রধান তিনি শান্তিতে নোবেল পেয়েছেন। ফলে তিনি শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখবেন। তিনি আন্তরিকতার সঙ্গে এখানে শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা রাখবেন।”
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা দেশের সব বিষয়ে কথা বললেও পার্বত্য অঞ্চলের এই বিষয়ে তাদের খুব একটা সোচ্চার দেখা যায়নি। কেন তারা এই বিষয়ে নীরব?
জানতে চাইলে অন্যতম সমন্বয়ক নুশরাত তাবাসসুম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এই ঘটনার সময় তিনি দেশের বাইরে ছিলেন। এখন দেশে ফিরেছেন। অবশ্যই এ ব্যাপারে খোঁজ নিবেন এবং যা করা দরকার সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নেবেন।”
আরেক সমন্বয়ক ওয়াহিদ উজ জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘প্রথম দিন থেকেই আমি নিজে এ ব্যাপারে খোঁজ রাখছি। পাহাড়ি ও বাঙালি ছাত্রদের সঙ্গে পৃথকভাবে আমরা কথাও বলেছি। তবে হ্যাঁ, মিডিয়াতে কিছু না বলার কারণে হয়ত অনেকে মনে করছেন আমরা খোঁজ রাখছি না। বিষয়টি এমন নয়। আমরা পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় কঠোরভাবে চেষ্টা করছি।”
জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের বাংলা সংস্করণের হয়ে ঢাকা থেকে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন সমীর কুমার দে। এই প্রতিবেদনের সব ধরনের দায়ভার ডয়চে ভেলের।